এক বিকেল স্মৃতিমধুর - রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প

এক বিকেল স্মৃতিমধুর - রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প

 গল্পঃ এক বিকেল স্মৃতিমধুর

লিখাঃ নুসরাত খন অনি

নিউমার্কেটের সামনে একটা ফাস্টফুডের দোকানে নাকে টিস্যু চেপে ধরে বসে আছি। পাঁচমাসের পেট নিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না বলে শফিক জোর করে আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে গেছে। আমি বসতে চাচ্ছিলাম না।  খাবারের গন্ধ যেন নাকে না লাগে সেজন্য টিস্যু ধরে রেখেছি৷ পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই অস্থিরতা ভর করলো শরীরে। আজকাল একটানা স্থির হয়ে কোথাও বসে থাকতে পারছি না। জরুরী কিছু কেনাকাটা করার ছিল তাই এ অবস্থায়ই বাসা থেকে বের হতে হয়েছে। শফিককে কত করে বললাম নতুন শাড়িটার সাথে ম্যাচিং ব্লাউজের কাপড় এখন না হলেও চলবে। সে শুনলোই না আমার কথা। চলে গেল ব্লাউজের কাপড় খুঁজতে। এদিকে আমার এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে।

চোখমুখ কুঁচকে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম একটা মেয়ে বাম হাত দিয়ে তার ডান হাতের বাহুটা উঁচু করে চেপে ধরে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাতের বাহু বেয়ে রক্ত ঝরছে৷ মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। আমার খানিকটা কৌতুহল হলো। তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে। 

খানিকবাদে একটা ছেলে দ্রুত পায়ে হেঁটে তড়িঘড়ি করে মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়ালো। জনসমাগম কম আর দূরত্ব বেশি না হওয়ায় আমি এখানে বসে ওদের আলাপচারিতা শুনতে পাচ্ছিলাম। ছেলেটা প্রথমে তার হাতে থাকা পানির বোতলটা খুলে মেয়েটার হাতের কাটা জায়গাটা যত্নশীল হাতে ধুয়ে দিল। মেয়েটা ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ছেলেটা তার পকেট থেকে রুমাল বের করে কাটা জায়গাটা বেধে দিয়ে মেয়েটাকে বলতে লাগলো;

- একটু সাবধানে চলাফেরা করবে না! কতবার করে বললাম আমার সাথে সাথে হাঁটো৷ শুনলে না। তারউপর আবার ফোন কানে ধরে রাস্তা পার হতে নিলে। আজ আমি সাথে না থাকলে কি ঘটে যেতে পারতো ভাবতে পারছো?

মেয়েটা কাতর কণ্ঠে প্রতিউত্তর করলো;

- বড় আপু ফোন করেছিলো। রিসিভ না করলে অহেতুক কথা শোনাতো। 

এরমধ্যে ছেলেটার মোবাইলে কল এলো৷ ফোনালাপে বুঝা গেল ছেলেটা তার মাকে আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছিলো। মা রেডি হয়ে বসে আছে। 

ছেলেটার চিন্তিত মুখ দেখে মেয়েটা বললো,

- তুমি আন্টিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও। আমি একা বাসায় চলে যেতে পারবো। 

- চুপ করো৷ আমাকে একটু ভাবতে দাও। 

কয়েক সেকেন্ড পর কিছু একটা ভেবে নিয়ে ছেলেটা বললো মেয়েটাকে;

- চলো আমার সাথে। 

- কোথায়?

- কোথায় আবার! ডাক্তারের কাছে। 

- লাগবে না। আমি যাওয়ার সময় ফার্মেসী হয়ে যাব। 

- কথা বলতে না করেছি না? যেটা বলছি সেটা শুনো। 

- মাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গিয়ে প্রেমিকাকে নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছো৷ ব্যাপারটা কি ঠিক হচ্ছে?

- আর কত দায়িত্বহীন মনে করবে আমাকে! মাকে আর তোমাকে একসাথেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। এবার ঠিক আছে?

- তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নিশ্চিত৷ 

- সময় নষ্ট করো না। চলো তাড়াতাড়ি৷ মা অপেক্ষা করছে। 

- কিন্তু আন্টির কাছে আমার কি পরিচয় দেবে? সত্যিটা তো বলতে পারবে না এখনি।

- সত্যিটা এমনিতেও কখনোই বলা হত না। আমার উপর ভরসা রাখো৷ দেখো কিভাবে ম্যানেজ করি পুরো ব্যাপারটা। তবে কথা দিচ্ছি, বন্ধুর বউ/বোন বলে পরিচয় দেবো না। 

চলে গেল দু'জন। আমার কৌতুহল যেন আরো দ্বিগুণ পরিমাণ বেড়ে গেল। খুব জানতে ইচ্ছে করছে ছেলেটা পুরো ব্যাপারটা কি করে ম্যানেজ করে। খানিকবাদেই শফিক ফিরে এলো। শপিং ব্যাগ থেকে ব্লাউজের কাপড়টা বের করে দেখিয়ে বললো;

- এই যে দেখো নিয়ে এসেছি। কালারটা ঠিক আছে না?

ব্লাউজের কাপড়ে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললাম,

- হ্যাঁ ঠিক আছে। এবার বাসায় চলো৷ আমার আর ভালো লাগছে না। 

শফিক ভ্রু কুঁচকে ফেললো;

- বাসায় যাব মানে! ডাক্তারের কাছে যাবার কথা ভুলে গেছো?

- আজ না গেলে হয় না?

- না, রিস্ক নেয়ার দরকার নেই। আমি সাথে আছি তো। এখন আর কোনো কষ্ট হবে না। 

হসপিটালে গিয়ে কাকতালীয়ভাবে ওই ছেলেমেয়ে দুটোকে পেয়ে গেলাম। তারাও একই হসপিটালে এসেছে। সাথে ছেলেটার মা'ও রয়েছে। খুশি খুশি লাগলো খুব। কিন্তু সে খুশি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না যখন মনে হলো ছেলেটা হয়তো তার মায়ের সাথে প্রেমিকার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এতক্ষণে। আমি শফিককে নিয়ে ওদের কাছাকাছি চেয়ারে গিয়ে বসলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেটার মা ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো;

- রাস্তায় কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেনি। তুমি অবশ্য কিছু বলতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি থামিয়ে দিয়েছিলাম। বিকেলের দু' আ গুলো পড়ছিলাম তো তাই। তা এখন কি জানতে পারি তোমার সাথের মেয়েটা কে?

কান খাড়া করলাম সাথে সাথে৷ ভদ্রমহিলার ভারী কণ্ঠ শুনে আন্দাজ করে নিলাম তিনি বেশ রাগী প্রকৃতির মানুষ। ছেলের ভয় পাওয়া যুক্তিসংগত৷ অপেক্ষা করতে লাগলাম ছেলেটার উত্তরের জন্য৷ বেশ আত্নবিশ্বাসী ভঙ্গিতে ছেলেটা তার মাকে বললো;

- আজকে মারাত্মক একটা দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো মা। রাস্তা পার হওয়ার সময় উল্টো দিক থেকে একটা বাস দ্রুত গতিতে চলে এসেছিলো। ঠিক সময়ে এই মেয়েটা এসে আমাকে সরিয়ে না দিলে কি যে হয়ে যেতো! কিন্তু দেখো, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বেচারি নিজের কি অবস্থা করেছে। হাত কেটে গিয়েছে, পায়ের গোড়ালিতেও আঘাত লেগেছে৷ এ অবস্থায় ওকে একা ছেড়ে দেয়া কি ঠিক হত? তাই তো আমাদের সাথে নিয়ে এলাম। 

ভদ্রমহিলা আদুরে দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালেন। তারপর ছেলেটাকে বললেন,

- আমার জন্য একটা খিলি পান নিয়ে এসো। সিরিয়াল আসতে এখনো অনেক দেরি৷ 

ছেলেটা পান আনতে চলে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা মেয়েটার গা ঘেঁষে বসে তার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন;

- তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? তোমার বাবার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যেও আমাকে, কেমন? 

সেই সাথে নিজের ছেলের গুনগানও গাইতে শুরু করলেন। উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মেয়েটার চোখজুড়ে খুশির জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো, যেটা ভদ্রমহিলার নজর এড়ালেও আমার নজর এড়ালো না। 

আমি পাশ ফিরে ক্ষীণ কণ্ঠে শফিককে জিজ্ঞেস করলাম;

- এই, তুমি বিয়ের আগে তোমার মায়ের সাথে আমাকে কি বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে মনে আছে?

আচমকা এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে শফিক চমকে উঠলো;

- হঠাৎ এ প্রশ্ন করছো কেন?

- আহ্, বলোই না।

- হ্যাঁ মনে আছে। ভার্সিটির সিনিয়র আপু বলে। 

আমি শফিকের নাক টেনে ধরে অভিমানী স্বরে বললাম;

"গাধা একটা"। 

(সমাপ্ত)

Post a Comment

Previous Post Next Post