ঐকতান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 


বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।

দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-

মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,

কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু

রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;

মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।

সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে

অক্ষয় উৎসাহে

যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী

কুড়াইয়া আনি।

জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে

পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।

আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি

আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,

এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক

রয়ে গেছে ফাঁক।

প্রকৃতির ঐকতানস্রোতে

নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে;

তাদের সবার সাথে আছে মোর এইমাত্র যোগ-

সঙ্গ পাই সবাকার, লাভ করি আনন্দের ভোগ,

পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,

বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার।

চাষি খেতে চালাইছে হাল,

তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-

বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার

তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।

অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে

সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।

মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,

ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।

জীবনে জীবন যোগ করা

না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।

তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা

আমার সুরের অপূর্ণতা।

আমার কবিতা, জানি আমি,

গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।

কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,

কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,

যে আছে মাটির কাছাকাছি,

সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।

এসো কবি অখ্যাতজনের

নির্বাক মনের।

মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার

প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার,

অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি

রসে পূর্ণ করি দাও তুমি।

অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি

তাই তুমি দাও তো উদ্বারি।

সাহিত্যের ঐকতানসংগীতসভায়

একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়

মূক যারা দুঃখে সুখে,

নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে,

ওগো গুণী,

কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি।

[সংক্ষেপিত]

Post a Comment

Previous Post Next Post