জসীমউদ্দীন
পল্লি-দুলাল, ভাই গো আমার যাব আমি-তোমার দেশে,
আকাশ যাহার বনের শীষে দিক-হারা মাঠ চরণ ঘেঁসে ।
দূর দেশীয় মেঘ-কনেরা মাথায় লয়ে জলের ঝারি,
দাঁড়ায় যাহার কোলটি ঘেঁসে বিজলী-পেড়ে আঁচল নাড়ি ।
বেতস কেয়ার বনে যেথায় ডাহুক মেয়ে আসর মাতায়,
পল্লি-দুলাল ভাই গো আমার, যাব সেথায় ।
তোমার দেশে যাব আমি, দীঘল বাঁকা পন্থখানি,
ধান কাউনের ক্ষেতের ভেতর সরু সুতোর আঁচর টানি,
গিয়াছে সে হাবা মেয়ের এলো মাথার সিঁথির মতো
কোথাও সিঁথে কোথাও বাঁকা গরুর গায়ের রেখায় ক্ষত ।
গাজন-তলির মাঠ পেরিয়ে শিমুলডাঙা বনের বায়ে
কোথাও গাঁয়ের রোদ মাখিয়ে ঘুম-ঘুমায়ে গাছের ছায়ে ।
তাহার পরে মুঠি ছড়িয়ে দিয়ে কদম-কলি,
কোথাও মেলে বনে পাতা গ্রাম্য মেয়ে যায় যে চলি ।
সে পথ দিয়ে যাব আমি পল্লি-দুলাল তোমার দেশে
নাম- না জানা ফুলের সুবাস বাতাসেতে আসবে ভেসে ।
তোমার সাথে যাব আমি, পাড়ার যত দস্যি ছেলে,
তাদের সাথে দল বাধিঁয়া হেথায় সেথায় ফিরব খেলে ।
ধল- দীঘিতে সাঁতার কেটে আনব তুলে রক্ত-কমল,
শাপলা লতায় জড়িয়ে চরণ ঢেউ- এর সাথে খাব যে দোল ।
হিজল-ঝরা জলের ছিটায় গায়ের বরণ রঙিন হবে
খেলবে দীঘির ঝিলিমিল মোদের লীলা কালোৎসবে ।
তোমার দেশে যাব আমি পল্লি-দুলাল ভাই গো সোনার,
সেথায় পথে ফেলতে চরণ লাগবে পরশ এই মাটি-মার ।
ডাকব সেথা পাখির ডাকে, ভাব করিব পাখির সনে,
অজানা ফুলের রূপ দেখিয়া মানবো তারে বিয়ের কনে ।
চলতে পথে ময়না কাঁটায় উত্তরীয় জড়িয়ে যাবে,
ইটেল মাটির হোঁচট লেগে আাঁচল হতে ফুল ছড়াবে ।
পল্লি-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে,
তোমার কাঁধে হাত রাখিয়া ফিরবো মোরা সাঁজ-বাগানে,
ফুল ফুটেছে হাজার রঙের মেঘ-তুলিকার নিখুঁত টানে ।
গাছের শাখা দুলিয়ে আমি পাড়ব সে ফুল মনের আশে,
উত্তরীয় ছড়িয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো বনের পাশে ।
যে ঘাটেতে ভরবে কলস গাঁয়ের বিভোল পল্লিবালা,
সে ঘাটেরি এক ধারেতে আসবো রেখে ফুলের মালা ।
দীঘির জলে ঘট বুড়াতে পথে-পাওয়া মাল্যখানি,
কুড়িয়ে নিয়ে ভাববে ইহা রেখে গেছে কেই না জানি ।
চেনে- না তার হাতের মালা হয়ত সে-বা পরবে গলে,
আমরা দু’জন থাকব বসে ঢেউ দোলা সেই দীঘির কোলে ।
চার পাশেতে বনের সারি এলিয়ে শাখার কুন্তল-ভর,
দীঘির জলে ঢেউ গণিবে ফুল শুঁকিবে পদ্ম-পাতার ।
বনের মাঝে ডাকবে ডাহুক, ফিরবে ঘুঘু আপন বাসে,
দিনের পিদীম ঢুলবে ঘুমে রাত জাগা কোন্ ফুলের বাসে ।
চার ধারেতে বন জুড়িয়ে রাতের আঁধার বাঁধবে বেড়া,
সেই কুহেলীর কালো কারায় দীঘির জলও পড়বে ঘেরা ।